Sunday, November 13, 2016

মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে

দূরদর্শী কবি অনেক আগেই  সমগ্র বাঙালি জাতিকেই সজাগ করেছিলেন -

বঙ্গমাতা -রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর

পূণ্যে পাপে দুঃখে সুখে পতনে উত্থানে
মানুষ হইতে দাও তোমার সন্তানে।
হে স্নেহার্ত বঙ্গভূমি, তব গৃহক্রোড়ে
চিরশিশু করে আর রাখিয়ো না ধরে।
দেশদেশান্তর-মাঝে যার যেথা স্থান
খুঁজিয়া লইতে দাও করিয়া সন্ধান।
পদে পদে ছোটো ছোটো নিষেধের ডোরে
বেঁধে বেঁধে রাখিয়ো না ভালোছেলে করে।
প্রাণ দিয়ে, দুঃখ স’য়ে, আপনার হাতে
সংগ্রাম করিতে দাও ভালোমন্দ-সাথে।
শীর্ণ শান্ত সাধু তব পুত্রদের ধরে
দাও সবে গৃহছাড়া লক্ষ্মীছাড়া ক’রে।
সাত কোটি সন্তানেরে, হে মুগ্ধ জননী,
রেখেছ বাঙালী করে, মানুষ কর নি।

আজকাল বাবা-মা 'রা যেহারে সন্তানদের পড়াশোনার দ্বায়িত্ব নিচ্ছেন ও সন্তানের সকাল সন্ধে আগলাচ্ছেন, তাতে দুধে-ভাতে পুষ্ট খোকারা তো বিনা হাত ধরে বড়ো হয়ে হাঁটতে পারবে না। অনেক জ্ঞান অর্জন করেও তো লেখাপড়ায় অগা মার্কা অবাঙালী ব্যাবসায়ীর চরণসেবা। আই এ এস হলে লালুর ছেলের মতো মনিব জুটবে। বাঙালির প্রথম যেটা দরকার ঝুঁকি নেবার সাহস।

Saturday, November 12, 2016

নিয়ন্ত্রণ



ম্যানেজমেন্ট কি আর ম্যানেজারদের  কাজ কি প্রশ্ন শুনলে প্রথমেই মাথায় আসে ম্যানেজ করা।  সত্যি কি এটাই পরিষ্কার  উত্তর ? স্পষ্ট করে বোঝাতে গেলে বলতে হবে ম্যানেজারের কাজ হলো নিয়ন্ত্রণ করা, আর ম্যানেজমেন্ট কোনো লক্ষে পৌঁছনোর নিয়ন্ত্রণ কৌশল।
জানি, নিয়ন্ত্রণ কথাটা শুনলেই মনে হয় মানুষ কি জ্ঞানতো চায় নিয়ন্ত্রিত হতে ? আপনার সঙ্গে আমি এক্কেবারে একমত, কেউ চায় না। যে পরিবারের ভালো-মন্দ  একজন বুদ্ধিমতি  নারী পরিচালনা করেন তার স্বামীকে আমাদের সমাজ দেখে হাঁসে, বলে স্ত্রৈণ। কিন্তু সাতসকালে বাজারের থলি রেখেই স্নান, তারপরে নাকেমুখে কোনোরকমে গুঁজে গবাদি পশুর মতো উপচে পরা বসে ট্রেনে অপিস। সেটা বুঝি  নিয়ন্ত্রণ নয়? ওই যে অপিস শুরুর ধাৰ্জিত সময়, ওটাই নিয়ন্ত্রণ। মানাজেমেন্টের স্বার্থকতা সেখানেই যেখানে পরিচালিত হলেও নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি মনে হবে না। সবই স্বতঃস্ফূর্ত ভাবে করে যাবেন এই ভেবে, এটাই  আমার চরম  উন্নতির পথ। 

ম্যানেজমেন্ট বা নিয়ন্ত্রণ কোনো নতুন বিষয় নয় যা কলেজেই  পড়ানো হয় , পৌরাণিক  যুগ থেকেই  মানুষ একে  অন্যকে নিয়ন্ত্রণ করে আসছে। শুনে আশ্চর্য লাগছে ? হাজার বছর আগে রামচন্দ্র যুদ্ধ কলাতে  অজ্ঞানী বানরদের  নিয়ন্ত্রণ করে তাদের দিয়ে সেতু বানিয়ে লঙ্কায় পৌঁছে বীর যোদ্ধাদের দ্বারা পরিবেষ্টিত রাবনকে পরাজিত করেছিলেন। আবার মহাভারতেও দেখুন  শ্রীকৃষ্ণ অর্জুন পান্ডবদের প্রতি পদে নিয়ন্ত্রণ করে ধর্মযুদ্ধ যেমন রচিয়েছেন তেমনই তার পরামর্শ নিয়ন্ত্রণে জিত  হয়েছে পান্ডবদের। কৃষ্ণের উদ্দেশ্য ছিল গীতার উপদেশ ধর্মের জিত মানব সমাজে প্রতিষ্ঠিত করা। ১৯১৩ সালে হেনরী ফোর্ড গাড়ি শিল্পে এক নিয়ন্ত্রণের ঝড় আনেন।  অ্যাসেম্বলি লাইন, যার ফলস্বরূপ ১২ ঘন্টার একটা গাড়ি তৈরির কাজ ৯০ মিনিটে  সম্ভব হয়। ফলে ৮৫০ ডলারের গাড়ি দাম কমে দাঁড়ায় মাত্র ৩০০ ডলার। আমেরিকার মদ্ধবিত্তের নাগালের মধ্যে চলে আসে গাড়ি।

৯০ এর দশকে মাঝামাঝি যতদূর মনে পরে মোবাইল ফোন ভারতে এলো।  থান ইঁটের মতো বিশাল ভারী সেটটার দামই ছিল আমাদের স্বপ্নের নাগালের বাইরে। আবার  ১৬ টাকা প্রতি মিনিটের আউটগোয়িং কল চার্জ।থান ইঁটের অধিকারী ভাগ্যবানেরা ওটাকে হাতে নিয়েই ঘোরাঘুরি করতেন যাতে লোকে তাঁর সামাজিক, আর্থিক প্রতিপত্তির একটা অভ্যাস পায়। ২০০২   রিলায়েন্স এসে রিকশাওলার হাতেও মোবাইল তুলে দিলো। আজকাল কেউ মোবাইল আর দেখায় না বরং পকেটে লুকিয়ে রাখে।  তার জায়গা নিয়েছে সোনার চেন। গলায় ঝুলিয়েই  শান্তি নেই জামার দুটো বোতামও  খুলে রাখতে হবে  নাহলে লোকে  দেখবে কেমন করে ? এসব বললাম কারণ কিছু ব্যক্তি তাদের অহং দ্বারা নিয়ন্ত্রিত।

এক প্রখ্যাত পানীয় কোম্পানীর জি এম বলেছিলেন আমাকে নাম ধরেই ডাকবেন, আমরা মার্কিন পদ্ধতিতে কাজ করি, স্যার ম্যাডাম আমাদের অপিসের কালচার নয়। আপনার প্রতিদিনের কাজ হওয়া চাই, অপিসে কখন এলেন কখন গেলেন আমি দেখতে যাবো না। আর একজন ম্যানেজার, মাসের প্রথমে  মিটিংয়ে  টার্গেট, কার কি কাজ, কোনটা অগ্রাধিকারী সবই পরিষ্কার আলোচনা করে নিতেন সকলের সাথে। দিনের শেষে ওনাকে শুধু দিতে হতো অগ্রগতির আপডেট।  তার টেবিলে নেই একটাও ফাইল, সমস্যার তাৎক্ষণিক সমাধানে বিশ্বাসী, কথা বলার অফুরন্ত সময়, অপিসের সকলেই যেন ওনার আন্তীয়।  ফলাফল, স্বেচ্ছায় যে কেউ কোনো বাড়তি কাজের দায়িত্ব নিতেন, প্রতিমাসে টার্গেটের ১৫-২০% বেশি আউটপুট।

কলকাতার এক গাড়ির ব্যবসায়ীর কথা বলি, নিজের বিশাল কারখানায় ঢুকতেন চুপি চুপি।  লুকিয়ে ঘুরে দেখতেন কে কি করছে।  ওনার পোষা ম্যানেজারদের ওপরে  কোনো আস্থা নেই।  কারখানার কর্মীদেরও  মাইনে যতো কম দেওয়া যায়। ওনার বক্তব্য, পশ্চিমবঙ্গে একজন গেলে আর একজন আসবে। সত্যিতো পশ্চিমবঙ্গে কাজের আকাল বহু কাল থেকে  বামফ্রন্টের আমল থেকে  অসহায় বেসরকারি কর্মীদের  ব্যাবসায়ীরা  নানা ভাবে শোষণ করছেন যেটা বলছিলাম এতো সত্যন্নেষী হওয়া সত্ত্বেও  ওনার কারখানাতে  চোরে চোরে মাসতুতো ভাইয়ের ছড়াছড়ি। প্রতি সপ্তাহেই কিছু না কিছু মূল্যবান গাড়ির পার্টস চুরি যেতো l

স্ত্রী বাড়ির থেকে একা বেড়োলেই স্বামী প্রতি ২০-২৫ মিনিট অন্তর  ফোনে  খবর নেয় কোথায় আছো ? কি করছো? সঙ্গে কে আছেইত্যাদি। অথচ বাড়িতে থাকলে ফোনই করে না। স্বামীর প্রেম দেখে স্ত্রীও আল্হাদিত হয়ে  সব জবাব দিতো প্রথমে। কিন্তু যেদিন থেকে  নিয়ন্ত্রিত হচ্ছি মাথায় ঢুকলো সেদিন থেকে ফোনই  ধরা বন্ধ। সাফাই, ব্যাগে ফোন ছিলো রাস্তায় এতো গাড়ির আওয়াজে শুনতেই  পাই নি।

কিছুদিন আগে এক প্রখ্যাত টিভি সাংবাদিক বলছিলেন ভারতবর্ষে এতো শব্দ দূষণ, চিৎকার না করলে কেউ কথা শোনে না। কখনো মনে হয়েছে কলকাতার প্রাইভেট বাসের কন্ডাক্টরের কথা ? বাস কন্ডাকটর শুনে নাক শেটকাচ্ছেন তো? সেওতো একজন  নিয়ন্ত্রণকারী ব্যক্তি। কিভাবে ? প্রতিদিন আপনার মতো কত জ্ঞানী লোককে সে সামলাচ্ছে তার হিসেবে রাখেন কিওর চেঁচানিতে সুর সুর করে গরু ছাগলের মতো ৩৪ জনের বাসে ১৫০ জন ভীড় করে যখন ওঠে তখন অত্যন্ত রুচিবান, শিক্ষিত, বুদ্ধিসম্পন্ন, ব্যাক্তিরা একবারও  ভাবেন কি বাসের  ভিড়ের মধ্যে পকেটটা কাটা যেতে পারে ? খোয়া যেতে পারে সাধের মোবাইলটা ? পাশের লোকটির  সুগন্ধি বগলের  ঘ্রাণ নাকে যাবে? আরেকজনের ঘর্মাক্ত শরীরের সাথে নিজেরটা  কচলাতে হতে পারেকাঁচা পিয়াজ দিয়ে সদ্য টিফিন করে আসা পাশের লোকটির বিশ্রী  নিঃশ্বাসের গন্ধ ? দাঁড়িয়ে যাবেন অতচ আপনি বসে যাবার ভাড়া দেবেন ? সর্বোপরি ভীড়ে অন্যের শরীরের কতো সংক্রমক জীবাণু আপনার শরীরে প্রবেশ করছে প্রতিদিন তার কি হিসেব রাখেন? সময়ের আর দূরত্বের দোহাই দেবেন তো? কার কি আসে যায় ? যেমন চলছে চলুক।  শরীরের নাম মহাশয় যেমন সাওবেন তেমন সয়।  আসলে পরিবহন কাঠামোর  নেতিবাচক দিকগুলোকে কেউ প্রচার করে না।  তাই অনেক জানা থাকলেও মাথার বিপদসঙ্কেত কার্যত ঘুমিয়েই থাকে

নিয়ন্ত্রণের আরো এক অতি ঘৃণ্য রূপ মানুষকে যন্ত্রনা বা  ভয় দেখিয়ে নিয়ন্ত্রণ করা। ব্রিটিশরা স্বাধীনতা সংগ্রামীদের ওপরে ভরপুর প্রয়োগ করেছে। দুর্ভাগ্যবশত এরকম  কিছু মানসিক বিকৃত ব্যক্তি অন্যত্র সুবিধে না করতে পেরে শিক্ষকতা করতে আসেন। সুখবর এই সব কসাইরা আজকের দিনে আইন অভিবাবকদের  নিয়ন্ত্রণে অনেক নিয়ন্ত্রিত।

ম্যানেজমেন্ট  অতি সুক্ষ প্রক্রিয়া যা কোনো লক্ষে ধাপে ধাপে পৌঁছনোর নিয়ন্ত্রিত প্রক্রিয়া। সুক্ষ এই জন্য বলছি, মানুষ নিয়ন্ত্রিত হচ্ছে বুঝলেই প্রক্রিয়ার বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করে উঠে   তবে এটাও ঠিক আমরা প্রতিদিন নানাভাবে নিয়ন্ত্রিত হয়ে চলেছি কিছু আমরা অনুমান করি কিছু আমাদের মাথার উপরদিয়ে হুস কোরে উড়ে যায়। খুবই কিঞ্চিৎ আমরা প্রতিবাদী হই

নেপালে আমার সহকর্মীকে ডাক্তার দেখতে নিয়ে গেছি। সামান্য সর্দ্দিজ্বর বললাম ভাইরাল ইনফেকশন আপনি সেরে যাবে।  মানসিকভাবে তার আবার ডাক্তারের লেখা ওষুধ না খেলে অসুখ সারবে না। যাই হোক তাকে নিয়ে গেলাম ডাক্তারের কাছে। নীল সুট লাল টাই পরা ডাক্তারের মুখে মুচকি  হাঁসি। মিষ্টি ব্যবহার, প্রেসার, গলা, বুকে পিঠে  স্টেথোস্কোপ দিয়ে দেখেই গোমড়ামুখে দুর্গাপুজোর ফর্দ লিখতে বসে গেলেন।
রক্ত পরীক্ষা, বুকের এক্সরে, ইউরিন, থুতু তারসঙ্গে - রকমের ওষুধ তাতে এন্টিবায়োটিক, এন্টি এলারজিক , কফ্ সিরাপ, প্যারাসিটামল সবই রয়েছে। গম্ভীর স্বরে বললেন : দিনের ওষুধ দিলাম আজ থেকেই শুরু করে দেবেন। হাসপাতালের দোকানেই  সবগুলো পেয়ে যাবেন আর পরীক্ষা গুলোও হাসপাতাল থেকেই  করাবেন।  সহকর্মীর মুখ কাঁচুমাচু পরীক্ষার খরচ অনুমান করে না  এতো ওষুধ দিলেন কেন ডাক্তারবাবু ভেবে? প্রেস্ক্রিপশন দেখে আমারও  চক্ষু ছানাবড়া। ডাক্তার কে জিজ্ঞেস করলাম : কি বুজলেন ?
ডাক্তার খুব চিন্তিত মুখে বললেন : ইনফেক্শনটা অনেকটা বাধিয়ে ফেলেছেন।
আর ধৈর্য রাখতে না পেরে বললাম : আপনি কি টি বীর আশঙ্কা করছেন ? রোগীর শরীরে তার কোনো সিম্পটন নেই। কি ইনফেকশনের কথা বলছেন ব্যাকটেরিয়াল  না ভাইরাল সেটা পরিষ্কার করে বলুন, প্রেস্ক্রিপশনেও লিখুন। 
আমার দিকে অবাক বিস্ময়ে চেয়ে ডাক্তার : আপনি কি ডাক্তার ?
উত্তরে বলি : মানুষের শরীরের সাধারণ জ্ঞান থাকার জন্য জানার ইচ্ছে থাকা চাই ডাক্তার হতে হয় না। একটা ভাইরাল জ্বরের  জন্য এতো ওষুধ এতো পরীক্ষা?
শুকনো মুখে ডাক্তার নতুন প্রেসক্রিপশন লিখলেন জ্বর বা ব্যাথায় শুধু প্যারাসিটামল, সব পরীক্ষা বাতিল।

বলতে খারাপ লাগে সমাজের একশ্রেণীর শিক্ষিত লোক সাধারণ মানুষের সরলতা বিশ্বাসের সুবিধা দিয়ে তাদের পকেটের ভার নিয়ন্ত্রণ করছেন।

লেখা পড়ে  ভালো লাগলে অত্যন্ত আনন্দিত হবো যদি অতি সংক্ষেপেও জানান।  আমার সঙ্গে একমত হতে হবে তারও কোনো মানে নেই। আপনার ভিন্নমত থাকলে  জানাতে ভুলবেন না।

Friday, October 7, 2016

শব্দ দূষণ

 বেশ কিছু বছর হল দেওয়ালি কালীপুজোর সময়ে শব্দ বাজি পোড়ানো সরকারি ভাবে বন্ধ হয়েছে। প্রশ্ন হল সত্যি কি বন্ধ হয়েছে? এক কাকুকে জিজ্ঞেস করতে উনি বললেন "আমাদের দেশে আইন হয় ভাঙার জন্য আর পুলিশ প্রশাসনের হাত কিঞ্চিত তৈলাক্ত করার জন্য।"

সরকারি ভাবে যদি আইন হয়ে থাকে তাহলে শব্দবাজি বিক্রী হয় কিভাবে ? আর পুলিশের নাকের ডগায় তাদের অজান্তে যদি তা হয়ে থাকে তাহলে এই পুলিশ জনসাধারণকে বড় বিপদ থেকে কি রক্ষা করবে ? তাদের কাছে তো কোনো খবরই নেই। আমাদের অতিপ্রিয়জনদের কোনো না কোনো কাজে হামেশাই জনস্রোতের মধ্যে যেতে হচ্ছে, সবসময়। আজকাল যারা দেশে বিদেশে মানুষের দুর্গতির কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে তারা কি জনসাধারণকে জানিয়ে বিপদ ঘটায়? কিছুদিন আগে ঢাকাতে কি কান্ডটাই না হয়ে গেলো। আমাদের পুলিশের নির্ভরযোগ্যতা কতোটা ? কলকাতা পুলিশের সদর দফতর স্কটল্যান্ড ইয়ার্ডের দূরত্ব বাস্তবে কিন্ত অনেক হাজার মাইল l

কিছু বছর আগে পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে দাঁড়িয়ে আছি হঠাৎ খেয়াল হল পুলিশ রয়েছে, ট্রাফিক সিগন্যাল লাইটও ঠিকঠাক কাজ করছে, কোনো যানজট নেই, চলমান গাড়ির সারি। তাহলে এতো শব্দবানের কি দরকারহর্ন বাজালে বুঝি গন্তব্যে চটজলদি পৌঁছনো যায়? নাকি এতে নাজেহাল গরমের থেকে  মেলে ক্ষনিকের পরিত্রাণ ? লক্ষ্য করছিলাম প্রত্যেক ১০টা গাড়ির মধ্যে  অন্তত পক্ষে ৬টা হর্ন বাজিয়ে তবেই এগোচ্ছে। কতো বিচিত্র রকমের আওয়াজে কান ঝালাপালা হবার জোগাড়। অহেতুক এই হন্কিং কি শব্দদূষণ নয় ?

লং ড্রাইভ ভীষণ প্রিয়, আর সুন্দর ঝলমলে বসন্তের রোদে হাইওয়েতে মোটরবাইক চালানোর আনন্দই আলাদা।  সঙ্গে ফাউ পথের ধারের ধাবার সুস্বাদু খানা চা। আগ্রা থেকে মোটরবাইকে যাচ্ছি মায়েনপুরী অপিসের কাজে সঙ্গে ফাইন্যান্স কোম্পানির অফিসার সিদ্ধার্থ শর্মা। আগ্রা থেকে দিল্লি রোড ধরে ফিরোজাবাদ ছাড়িয়ে পৌঁছলাম শিখোয়াবাদ। এখানকার একটা ধাবার তারকা চা আমার খুব প্রিয়। খানাপিনার পরে আবার পথে   এবারে জাতীয় সড়ক ছেড়ে বাম দিকের রাজ্য সড়ক দিয়ে যেতে হবে। সিদ্ধার্থ বল্লো, "স্যার দিন, বাকি রাস্তাটুকু আমি চালাই।" সিদ্ধার্থ বাইক চালাচ্ছে আমি পিছনে বসা, ফাঁকা রাস্তার দুদিকে কৃষিজমি মাঝে মাঝে ছোট গ্রাম। লক্ষ্য করলাম ফাঁকা রাস্তাতেও সিদ্ধার্থ বেশ 'বার হর্ন দিলো। থাকতে না পেরে জিজ্ঞেস করলাম, "ফাঁকা রাস্তায় হর্ন বাজাচ্ছেন কেন ?" উত্তর এলো, "আপনি এতটা রাস্তায় একবারও হর্ন বাজাননি তাই দেখছিলাম আপনার হর্ন ঠিক আছে কি না।"

কিছু মাইল পরে রাস্তায় গতিরোধক দেখে গতি কমাবার সাথে সাথে আবার হর্ন। স্পীড ব্রেকারের সাথে হর্নের কি সম্পর্ক্ক? সিদ্ধার্থ বলল "ঐযে গতির ছন্দপতন হল, তাই হর্ন।"
দুদিকে সর্ষের ক্ষেতে হলুদ ফুল, মসৃন ফাঁকা রাস্তায় আমাদের আগে পিছে কেউ নেই।  একজায়গায় রাস্তার একদিকের ক্ষেতের জল উপচে অন্নপাড়ে বয়ে যাচ্ছে তাই দেখে আবার হর্ন ! এবার আমার জিজ্ঞেস করার আগেই সে খানিক হেঁসে বললো, "কি করবো স্যার হর্ন না বাজিয়ে গাড়ি চালাতে পারি না, অভ্যাস।"

হিমাচলে এক পাহাড়ী পাকদন্ডি পথে চলেছি। গাড়ির ড্রাইভার প্রতি বাঁকের আগে হর্ন বাজিয়ে তবেই পাহাড়ি পথের বাঁক নিচ্ছে। আমার স্ত্রীর কাছে ব্যাপারটা অস্বাবাভিক ঠেকাতে আমাকে জিজ্ঞেস করলো, "প্রতি বাঁকে হর্ন বাজানো কি কোনো পাহাড়ী প্রথা?" উত্তরে আমি বললাম, না।  উল্টোদিক থেকে আসা যানকে আগেভাগে সতর্ক করা সংঘর্ষ এড়ানোর জন্য হর্ন। আমার উত্তরে স্ত্রী তো সে হেসেই খুন, "যে যার লেনে গাড়ী ঠিকমতো চালালে সংঘর্ষ হবে কেন?"


অবাক হচ্ছেন? আমেরিকাতে অনেক পাহাড়ি পাকদন্ডী পারি দিয়েছি। আমার মনে পড়েনা একবারও কাউকে হর্ন বাজাতে শুনেছি। অহেতুক হর্ন বাজানো এখানে অভদ্রতা। আমাদের দেশে ড্রাইভিং লাইসেন্স, দালাল চক্রের দৌলতে একটা প্রহসণে পরিণত হয়েছে। আগে লোকে লাইসেন্স পায় তারপরে গাড়ি চালাতে শেখে। কোনো দ্বিমত ? যুক্তরাষ্ট্রে, গাড়ী চালানোর পার্মিট সরকারের তরফ থেকে আপনাকে দেওয়া এক বিশেষ সুবিধা যতদিন পথঘাটের নিয়ম পালন করবেন ততদিন আপনার ড্রাইভিং পারমিট বহাল থাকবে নচেৎ ভোকাট্টা।